তারিখটা মনে নেই, হঠাৎ করে একদিন হাসান ভাই ফোন দিল, বরিশাল বেড়াতে যাওয়ার জন্য। আমার সেসময় সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। তবে এবারের রুটিনটা করেছে দীর্ঘ সময়ের। ২৪ তারিখ একটা এক্সাম হয়ে যাওয়ার পরে ৩ তারিখ আরেকটা এক্মাম আছে! তাই বিশাল এই ফাকে ট্যূর মিস করার ইচ্ছা হল না। হ্যা করে দিলাম। আর মজার ব্যাপার হল ট্যুরে থাকছে আমার ভার্সিটির বন্ধু আশিক আর বাহাউদ্দিন। ট্যুরটি মূলত একটা ফ্যামিটি ট্যুর হচ্ছে। হাসান ভাই আর আশিক দুজন নিজের ভাই। ওদের মামা অনেকদিন পর সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছে। তাই মূলত এই ফ্যামিলি ট্যুর।
২৫ তারিখ বিকেল ৪ টার দিকে আমি আর বাহাউদ্দিন বের হলাম সদরঘাট যাওয়ার জন্য। বাহাউদ্দিন আর আমি দুজনই মোহাম্মদপুরে থাকি। দুজন পাশাপাশি দুই রোডে বাসা। ২৫ তারিখ ছিল সরকারী ছুটি। জন্মাষ্ঠমী। এই অনুষ্ঠানের র্যালির জন্য ঢাকার সব রাস্তায় জ্যাম। বিশেষ করে পুরান ঢাকায়। আমরা ঠিক করলাম CNG করে যাব। এতে সময়ও বাচবে আর বিকপ্ল রাস্তা দিয়ে তাড়াতাড়ি পৌছানোও যাবে। নিলাম সিএনজি। অনেক ঘুরে ফিরে পৌছেও গেলাম পুরান ঢাকায়। তখন সবে বাজে ৫:৩০। লঞ্চ নাকি ছাড়বে ৮:৩০ এ। এতক্ষণ কি করব, তাই আশিক ওদের বাসায় এসে নিয়ে গেল। ওদের বাসা পুরান ঢাকাতেই। ৬ তলায় থাকে। কষ্টেমষ্টে উঠলাম। এরপর ওখানে গল্পগুজব আর কোথায় কোথায় ঘুরব টুরব এসব প্লান করে নিলাম।
৮টায় সবাই মিলে সদরঘাট পৌছলাম। ওখানে গিয়ে দেখি আরেক বন্ধু নাঈম হাজির। ওর এই ট্যুরে যাওয়ার কথা ছিল না। সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছে। নাঈম যে ট্যুরে যাবে এটা আমি আর বাহাউদ্দিন বিকেলে CNG তে উঠার সময়ই জানতে পেরেছিলাম। ও ফোন দিয়েছিল। কিন্তু একথা আশিক জানেনা। ঠিক করেছিলাম ওকে একটা সারপ্রাইজ দিই। নাঈম কিন্তু খুব ভাল গান গাইতে ও গিটার বাজাতে পারে। তাই ও আসাতে সবাই মোটামুটি খুশি।
সবাই লঞ্চে উঠেছি, লঞ্চের নাম সুন্দরবন নেভিগেশন। বিশাল লঞ্চ, বিলাশবহুল এবং বেশ আধুনিকও। অপেক্ষা করছি কখন লঞ্চ ছাড়ে, ছাড়ার কথা ছিল ৮:৪৫ এর আর শেষমেষ ছাড়ল ৯:৩০ এর দিকে। আসলে বাংলাদেশে দূরপাল্লার বাস ছাড়া সব পরিবহনই লেট করে ছাড়ে বোধহয়।
ছবিঃ আশিক (আগের তোলা)
লঞ্চ পূর্ণ গতিতে চলছে। লঞ্চের সামনে গিয়ে আমরা ছেলেরা সবাই গল্পগুজব করছি আর পরিবেশটাকে উপভোগ করার চেষ্ট করছি। চারিদিকটা দারুন লাগছে। ঠান্ডা বাতাশ আর দুপাশে অথৈ পানি। পূর্ণিমা রাত ছিল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ তাই আকাশ মেঘলা ছিল সেদিন। চাঁদ মামার দেখা পাওয়ার আশায় গুড়েবালি। অনেকক্ষণ শরীরে বাতাশ লাগিয়ে কেবিনের দিকে এলাম। আমাদের দুটি কেবিন। একটিতে মহিলারা থাকবে আরেকটিতে আমরা পুরুষরা। মানুষ সর্বমোট ১৬ জনের মত, তবে সবার যেতেহু রাত জাগার পরিকল্পনা ছিল তাই এতে কোন সমস্যা হয়নি।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল
আমরা পুরুষরা সবাই এক কেবিনে মোটামুটি গাদাগাদি করে বসলাম। গান হবে সরারাত। নাঈম গান করবে আর গিটার বাজাবে। সাথে আমরাও গান গাব আরকি। শুরু হল আসর। একটার পর একটা দারুন দারুন গান গাচ্ছি সবাই মিলে। সবাই মুগ্ধ। বাইরে মহিলারাও এসেছে আমাদের গান শুনতে। আসর বেশ জমেছে বোঝা যাচ্ছে। রাত দুটার দিকে আসরের বিরতি নিলাম সবাই। একটু চা-কফি খাই আর জিরিয়ে নেই আরকি। এরই মধ্যে আগেই রাতের খাবারও সেরে ফেলেছি সবাই।
বিরতি শেষে রাত ৩টার দিকে কেবিনের বাইরে আবার শুরু হল গানের আসর। মোটামুটি সবাই গান শোনার জন্য ন্যাটা পেড়ে বসলাম, কেউ কেউ চেয়ারে বসেছে, কয়েকজন দাড়িয়ে আছে। আবারও দারুন দারুন গান চলছে।
মুষল ধারে গান চলছে
৪টার দিকে গানের আসর শেষ করে সবাই একটু জিরিয়ে নিচ্ছি। ঘণ্টাখানেক চুমুক টাইপ একটা ঘুম দিয়ে ৫টার দিকে বরিশালের লঞ্চঘাটে পৌছুলাম। যেহেতু ফ্যামিলি ট্যুর আর বিশাল জনসংখ্যা তাই আমাদের চার বন্ধুর প্লান ছিল আলাদা করে একসাথে ঘুরার। আমরা আশিক, বাহাউদ্দিন, নাঈম আর আমি বেরিয়ে পড়লাম বরিশালের দপদপিয়া সেতু দেখার জন্য। সূর্য ওঠার আগেই ওখানে পৌছে গেলাম CNG চালিত অটোরিকশাগুলিতে। সকালে রাস্তা ফাকা ছিল তাই বেশ তাড়াতাড়িই পৌছেছি। দপদপিয়া সেতুটি সমতল ভুমি থেকে অনেক উচু তাই ওখান থেকে সূর্যোদয় অনেক ভাল দেখা যায়। সকালেও আকাশ খানিকটা মেঘলা ছিল তাই ভালমত দেখতে পারিনি। তবে ওখানের মুহুর্তটা দারুন ছিল। সেতু থেকে আশেপাশের দৃশ্য চমৎকার দেখা যায়। আধঘণ্টার মত ওখানে থেকে সেতু থেকে নেমে আসছি। নিচে অনেক শালিক দেখতে পেলাম। আমি কখনো এত শালিক একসাথে দেখিনি।
দপদপিয়া সেতু
ওখান থেকে আবার অটোরিকশা করে চলে আসলাম বাস কাউন্টারে। উদ্দেশ্য ঝালকাঠি যাওয়া। বাসে করে ঝালকাঠি পৌছে প্রথমেই নাস্তা করে নিলাম। এরপর একটা অটোরিকশা ঠিক করে চলে আসলাম গাবখান সেতু দেখতে। এই সেতুটি দপদপিয়া সেতুর থেকেও উচু। চারিদিকে মুগ্ধকর পরিবেশ। অনেক উচু হওয়ায় স্থানীয় লোকজন নদী দিয়েই এখনো নৌকায় পারাপার হয়। এতে তাদের বেশ সময় বেঁচে যায়।
গাবখান সেতু
গাবখান নদী
সমতলভূমি থেকে সবচেয়ে উচু সেতু
গাবখান নদীতে লঞ্চ
সেতু দেখা শেষে অটো করে ফেরার পথে কাছেই নেছারাবাদ দরবার শরীফ দেখতে গেলাম। বিশাল বড় কমপ্লেক্স। সাথে মসজিদ, মাদ্রাসা ও কয়েকটি সংযুক্ত ভবন। আমরা অটো থেকেই দেখেছি। ভিতরে নাকি ছবি তুলতে দেয়না।
নেছারা দরবার শরীফ
দরবার শরীফ দেখা শেষে এবার আবার অটো করে রওনা দিলাম আতঘর, ঝালকাঠিতে। উদ্দেশ্য বিখ্যাত ভাসমান পেয়ারা বাজার দেখা। ওখানে গিয়ে দেখলাম বাজার নেই। এই পেয়ারা বাজার ভিমরুলি বাজারে বসে। তো আতঘরেই নামলাম সবাই। ওখানে নৌকার বাজার বসে। নদিতে অনেকগুলি নতুন নৌকা সারি সারি করে রাখা হয়েছে। উপরে আবার বৈঠার আলাদা দোকান। দারুন এক অভিজ্ঞতা। আমি জীবনেও এতগুলি নতুন নৌকা একসাথে দেখিনি।
আতঘর নৌকার বাজার
লোকজনকে কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম নৌকার দাম কেমন। বলে ২,৫০০ থেকে ৩ হাজারের মধ্যে। আমরা সবাই দাম শুনে অবাক। আমরা মনে করেছিলাম ১০-১২ হাজারে মতন হবে।
বৈঠার দোকান
ওদেরকে মজা করে বললাম। আমরা একটু বড় হলেই বাবার কাছে সাইকেল কিনে দেয়ার বায়না ধরি আর এখানকার ছেলেপেলেরা বোধহয় নৌকা কেনার বায়না ধরে! হা হা!
পেয়ারার বাজার পাশেই ছিল। আরেকটু অটো করে যেতে হবে। পরে আমাদের মাঝে ব্যক্তিগত একটা ঝামেলার কারণে কারোর আর ওখানে যাওয়া হল না। অটো করে এবার রওনা দিলাম উজিরপুর, বরিশালে। ওখানে বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ইদগাহ কমপ্লেক্স দেখার জন্য।
যাওয়ার সময় একটা ছোট বাজারে নামলাম। ওখান থেকে বাসে করে যেতে হবে। বাসস্টানের পাশে কিছুক্ষণ সবাই জিরিয়ে নিলাম। গ্রাম্য বাজারে বিশাল এক মিস্টির খোলা দোকান। সবাই দই আর বাতাশা খেলাম।
মিস্টির দোকান
বাসে করে পৌছে গেলাম মসজিদে। যেতেহু শুক্রবার ছিল, মোটামুটি ওখানেই জুমার নামাজ পড়ার প্লান ছিল। কিন্তু পৌছে দেখি দুপুর ২টা ছুইছুই। নামাজও শেষ হয়ে গেছে।
বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ইদগাহ কমপ্লেক্স গেইট
তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কারণ মসজিদের গেইট দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪:৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ভিতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দারুন সুন্দর মসজিদ। অনেকটা এরিয়া জুড়ে মসজিদটি। সাথে ইদগাছ কমপ্লেক্স থাকায় বিশাল মাঠ। গেইট দিয়ে ঢুকতেই ডানদিকে বিশাল পুকুর।
বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ইদগাহ কমপ্লেক্স
বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ইদগাহ কমপ্লেক্স এর পিছনে
পাশ দিয়ে হাটার রাস্তা
সবাই মিলে চারিদিকটা ঘুরে দেখলাম। খুবই সুন্দর মসজিদ। মসজিদটি যিনি নির্মান করেছেন উনি নাকি বিশাল ধর্নাঢ্য ব্যক্তি। মসজিদে এক সাইডে দেখলাম হেলিপ্যাডও আছে!
মসজিদের হেলিপ্যাড
শুক্রবার থাকায় গেইট নির্ধারিত সময়ে বন্ধ করতে পারেনি। গেইট কেবল বন্ধ করবে করবে অবস্থায় সবাই বেরিয়ে পড়লাম। আশেপাশে ভাল খাবার হোটেল পাওয়া গেল না। পাশের একটা দোকান থেকে বিফরোল খেয়ে ওখান থেকে বেরীয়ে পড়লাম দুর্গাসাগর দীঘি দেখব বলে। এটা মাধবপাশা, বাবুগঞ্জ, বরিশালে অবস্থিত। এখানে আমাদের জন্য ওয়েট করছে আমাদের বাকি সবাই। এখানেই সবাই একসাথে হব।
ভিতরে ঢুকে আবার সবার সাথে দেখা হল। দূর্গাসাগর দীঘি অনেক বিশাল। সারাদিন রোদের মধ্যে ঘুরেছি। তাই সবাই মোটামুটি ক্লান্ত ছিল।
দিঘী পেয়ে আমাদের আর লোভ সামলানো গেলো না। সবাই নেমে পড়লাম দিঘীতে গোসল করার জন্য। আশিক নামলোনা। ও সাতাঁর জানে না। সবাই ডাকলাম ওকে পাহারা দিয়ে গোসল করানো বলে। তাঁকে আর মানানো গেল না।
গোসল করে উঠে একটু পরে দীঘির চারিদিক ঘোরার জন্য আমরা চারজন বের হলাম। অনেক বড় দীঘি তাই অনেকটা ঘুরতে হবে। আশেপাশে অনেক কাপল লুতুপুতু করে প্রেম করছে। চারিদিকের শান্ত পরিবেশটা বেশ ভালই। প্রেম করার জন্য আসলেই অনেক ভাল জায়গা।
দূর্গাদীঘির পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার পথ
আমরা ফিরে আসার পর সবাই ঠিক করল এখান থেকে ৬টায় বের হব। কারণ লঞ্চ ৭:৩০ এ। তখন বাজে ৫টার মত। তাই চিন্তা করলাম গিটারটা নিয়ে আমরা একটু দূরে গিয়ে নিরিবিলিতে গান গাই। আমাদের সাথে কারো প্রেমিকা ট্রেমিকা আসে নাই। তাই এটাই ভরসা নিরিবিলি উপভোগ করার জন্য।
সৃতিবিজড়িত গাছ
৬টায় অটো করে বরিশাল লঞ্চঘাটে ফিরে আসলাম। এবার সুন্দরবন লঞ্চটিতে কেবিন পাওয়া যায়নি। এই লঞ্চ অনেক পপুলার হওয়ায় ২দিন আগেথেকেই বুক করতে হয় নাহলে পাওয়া যায়না। আমরা অন্য একটি লঞ্চে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে আবার রওনা দিলাম।
এবার রাতে আর গান করা হয়নি কারোর। সবাই ক্লান্ত। তাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার মত ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে আমরা ঢাকায় সদরঘাটে পৌছলাম।
এইতো! এভাবেই শেষ হল আমাদের বরিশাল ভ্রমন। আল্লাহর রহমতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। আলহামদুল্লিাহ 🙂